পরিচালকঃ ফ্র্যাঙ্ক ডারাবন্ট

অভিনয়ঃ টিম রবিন্স, মরগ্যান ফ্রিম্যান, বব গানটন, জেমস হোয়াইটমোর।
IMDB: 9.3

“Fear can hold you prisoner. Hope can set you free”

আমি আজও জানি না সেদিন দুই ইতালিয়ান গায়িকা কি বিষয়ে গেয়ে যাচ্ছিলেন। সত্যি কথা বলতে আমি জানতেও চাই না। কিছু কথা অব্যাক্ত থাকায় শ্রেয়। আমি এটা ভেবেই খুশী হই যে তারা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এমন সুন্দর কিছুই গেয়ে যাচ্ছিলেন। অপ্রকাশের যন্ত্রনা হৃদয়ে সুখকর ব্যাথার সৃষ্টি করে। এই ধুসর কারাগারে আটকে থাকা কষ্টের চেয়েও সেদিনের সেই কন্ঠ অনেক বেশী কষ্টকর, অনেক বেশী যন্ত্রনার আর দীর্ঘ ছিলো। এত বেশী তিক্ত যা কেউ কল্পনা করতেও ভয় পাবে। যেন একটা সুন্দর ছটফটে পাখি এই একঘেয়ে খাচাতে এসে আটকে গেছে আর তার চিরচেনা দেয়ালগুলো আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই যন্ত্রনাদায়ক কন্ঠের কারনেই শশাঙ্কের প্রতিটি মানুষ সেদিন নিজেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও মুক্ত মনে করেছিলো”

হতাশাগ্রস্থ জীবন, মুক্তির স্বপ্ন আর আত্মার স্বাধীনতা - ফ্রাঙ্ক ডারাবণ্ট পরিচালিত দ্যা শশাঙ্ক রিডেম্পশান” মুভির মুলমন্ত্র। না... এই মাপের মুভি নিয়ে লেখার মত যোগ্যতা আমার নেই; শুধুমাত্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আমার আগে বহু চলচ্চিত্র বোদ্ধা তাদের তুখোর লেখনী এবং মেধার সাহায্যে শশাঙ্কের কারাগার সম্পর্কে লিখেছেন এবং ভবিষ্যৎ এ আরো লিখবেন। আসলে কিছু কিছু বিষয়’ই আছে এমন যা শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ‘শশাঙ্ক রিডেম্পশান’ এমন’ই কিছু একটা। মুভি নিয়ে যাদের ই নুন্যতম লেখালেখি করার অভ্যাস আছে তাদের’ই অতি পছন্দের বিষয় চলচ্চিত্র জগতের এই মুকুটহীন সম্রাট কে নিয়ে কলম ধরা। মুকুটহীন সম্রাট’ই বটে; না আছে কোনো অস্কার, না আছে গোল্ডেন গ্লোব। দুর্ভাগ্য’ই বলা চলে। “ফরেষ্ট গাম্প” আরা “পাল্প ফিকশান” জিততে দেয় নি ৬৭ তম অস্কার। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট এর ক্রিটিকেরাও মুভিটিকে ৭২ তম পজিশানে রেখেছে সেরা ১০০ এর মধ্যে। কিন্তু জনগনের ভালোবাসা কিভাবে দূরে রাখবে? তাদের ভোটে এখনো বিশ্বের সেরা মুভি দ্যা শশাঙ্ক রিডেম্পশান”। হয়তো সারাজীবন’ই থাকবে কারন মুভিতেই তো বলা হয়েছে ভালো কোনোকিছুর’ই মৃত্যু নাই

মুভির কাহিনী না বলাই শ্রেয়। তবু যারা এখনো এই দূর্লভ মুগ্ধতাতে নিজেকে সিক্ত করেননি তাদের উদ্দেশ্যে দু’টো কথা বলি। ১৯৪৭ এ ব্যাংকার এ্যান্ডি ডুফ্রেন্স (টিম রবিন্স)  এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে তার স্ত্রীকে এবং তার স্ত্রীর প্রেমিক কে খুন করার। উকিলের সামনে অভিযোগ প্রমানে ব্যার্থ হওয়াতে তার যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। পাঠিয়ে দেয়া হয় শশাঙ্কের কারাগারে। গুয়ান্তানামো কারাগারের নাম শুনেছি আমরা; শশাঙ্কের কারাগার যেন গুয়ান্তানামোর’ই প্রতিরূপ। ওয়ার্ডেন নর্টন (বব গুনটন) মানুষরূপী নরপিশাচ। তার ডানহাত ক্যাপ্টেন হ্যাডলি (ক্ল্যান্সি ব্রাউন)। সাথে যুক্ত হয়েছে হে-উড এর পাশবিক লালসা এবং তার গ্যাং। এত কিছুর ভিড়েও এ্যান্ডি খুজে পায় এক অমুল্য রত্ন; ‘রেড’কে (মর্গান ফ্রিম্যান)। তার সাহায্যে একটি পাথর খোদাই করার হাতুরিও পায় এ্যান্ডি। কিন্তু কি করবে সে এই হাতুরি দিয়ে? রেড তো আগেই তাকে বলে দিয়েছে কারাগারের পাথুরে দেয়াল খোদায় করতে ৬০০ বছর লেগে যাবে। যারা দেখেন নি মুভিটা তাদের জন্য এইখানে দাঁড়ি দেই; নইলে পরে আমাকে বকবেন।

নরকের প্রতিও মানুষের ভালোবাসা জন্মে; এই কারাগার থেকে যখন কেউ ছাড়া পায় তখন সে বড্ড একা হয়ে যায়। ব্রুক্স যখন ৫০ বছর পরে এই নরক থেকে প্যারোলে ছাড়া পেলো সে একটি চিঠি লিখে রেড কে। চিঠিটা বাংলাতে লেখার লোভ সামলাতে পারছি নাঃ

  বন্ধুরা, বহিঃবিশ্ব যে এতটা গতিময় তা বিশ্বাস হতে চায় না। যখন ছোট্ট ছিলাম, তখন একবার একটা গাড়ি দেখেছিলাম আমি। কিন্তু এখন... গাড়িতে ভরে গিয়েছে শহর। পুরো পৃথিবীটাই যেন অনেক ব্যাস্ত। প্যারোল বোর্ড আমাকে যে বাড়িতে থাকার জায়গা দিয়েছে তার নাম ‘ব্রিউয়ার’। একটি চাকরীও দিয়েছে সাথে গ্রোসারীতে পন্য ব্যাগে ভরে দেবার। কঠিন কাজ, তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু জানো তো বয়স হয়েছে; হাত প্রায়শই ধরে আসে। ম্যানেজার আমাকে খুব একটা পছন্দ করে বলেও মনে হয় না বৃদ্ধ বলে। কাজ শেষে মাঝে মাঝে পার্কে যাই পাখিদের খাওয়াতে। আর ভাবি ‘জেড’ (পোষা কাক) আকাশে উড়তে উড়তে কোনোদিন আমাকে খুজে পাবে। সে যেখানেই থাকুক, আশা করি ভাল আছে আর নতুন অনেক বন্ধুও জুটিয়েছে। রাতে ঘুম আসে না আমার; ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। মাঝে মাঝে ভুলে যাই কোথাই আছি। ইচ্ছে করে একটা পিস্তল জোগার করে দোকানে ডাকাতি করি যাতে তারা আমাকে আবার আমার বাসাতে ফেরত পাঠায়। সাথে যদি ম্যানেজারকেউ খুন করতে পারতাম! কিন্তু বড় বেশি বৃদ্ধ হয়ে গেছি আমি এমন কাজ করতে। এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না, সব সময় ভয় পেতে পেতে আমি ক্লান্ত। ঠিক করেছি... আর থাকব না। মনে হয় না কারো কিছু এসে যাবে এই বুড়ো মানুষটার জন্য”

এ্যান্ডির স্বপ্ন শেষ হয় না। যখন সে ছাড়া পাবে এখান থেকে , চলে যাবে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে মেক্সিকোর এক উষ্ণ সৈকতে যে কোনো স্মৃতি ধরে রাখে না। রেড এখন আর কোনো স্বপ্ন দেখে না। তার পুরো পৃথিবী’ই এই কারাগার। তবে সে হতাশ নয়; এটা টের পাওয়া যায় তার প্রতিটি কথাতেঃ

এই কারাগারের দেয়ালগুলো বড় আজব। প্রথমে ঘৃনা করে শেখাবে, তারপর অভ্যাসে পরিনত করবে। একসময় তুমি কখন নির্ভর করতে শুরু করবে নিজেও জানো না। আর একেই বলে মানিয়ে নেয়া”

মুভিতে অভিনয় নিয়ে সমালোচনা করার প্রশ্নই আসে না। মর্গান ফ্রিম্যানের ন্যারেশান মুগ্ধ হয়ে শুনেছি; প্রতিটি কথা মনে রাখার মত। মুক্তির ২০ বছর পরেও মানুষকে ভালোবাসায় সিক্ত করে আসছে “দ্যা শশাঙ্ক রিডেম্পশান”। ক্লাসিক এই মুভির পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক ডারাবন্ট এবং মূল বইয়ের লেখক স্টিফেন কিং এর জুটি এর পরেও গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে মানুষের কাছে “দ্যা গ্রিন মাইল”, “দ্যা মিষ্ট” এবং “দ্যা ওয়াকিং ডেড” এ।

কিছু ফ্যাক্টসঃ

  • এ্যান্ডি চরিত্রটি টম হ্যাংকস্‌ কে লক্ষ করে তৈরী করা হয়েছিলো। কাজ ও শুরু করেছলেন টম। কিন্তু “ফরেষ্ট গাম্প” মুভির জন্য কাজটি ছেড়ে দেন তিনি।
  • স্টিফেন কিং তার বই এর স্বত্ব বিক্রি করেছিলেন মাত্র এক ডলারে। পরে অবশ্য তাকে উপযুক্ত অর্থ প্রদান করা হয়।
  • মুভির প্রথমে এ্যান্ডি আর রেড কে বেসবল বল নিয়ে খেলতে দেখা যায়। এই শূটিং টি ৯ ঘন্টা ধরে করা হয় এবং পরেরদিন মর্গান ফ্রিম্যান তার হাত স্লিং এ ঝুলিয়ে শুটিং এ আসেন।
  • মুভিটি মুক্তি পাবার পরে বক্স অফিসে মুখ থুবরে পরে। এর তিন লক্ষ বিশ হাজার কপি নষ্ট হয়ে যাবার ভয় দেখা দেয়। অথচ পরে ১৯৯৫ সালের সবচাইতে বেশী ভাড়া হওয়া মুভিতে পরিনত হয়।
  • পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক ডারাবন্ট এই মুভির কোনো ডিরেক্টরস্‌ কাট বের করেন নি কারন তিনি নিজেই ভীষন লজ্জিত কেটে ফেলা অংশগুলো দেখে।
  • এই মুভির ইটালিয়ান নাম “Le ali della libertà” যার ইংরেজি “The Wings of Freedom”.
  • টমি উইলিয়ামস চরিত্রের জন্য ব্র্যাড পিটকে পছন্দ করা হয়েছিলো প্রথমে।
  • প্যারোল পেপারে তরুন রেড হিসেবে যাকে দেখানো হয়েছে সে আসলে মর্গান ফ্রিম্যানের ছেলে আলফান্সো ফ্রিম্যান।
  • এ্যান্ডি হামাগুরি দিয়ে নোংরা যে পাইপ দিয়ে বের হয় সেটার থিকথিকা পদার্থ আসলে চকলেট সিরাপ দিয়ে তৈরী। মজার বিষয় হলো কেউ যদি শশাঙ্কের সেট এ যায় সে এখনো নাকি চকলেটের গন্ধ পায়।
পরিশেষে অতি প্রিয় একটি সংলাপ যা এ্যান্ডি রেডকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ

“Remember, Red, hope is a good thing, maybe the best of things. And no good thing ever dies.”

 
পরিচালকঃ ডেনিশ ভিলেনিয়ুভ

অভিনয়ঃ হিউ জ্যাকম্যান, জেক ইলেনহ্যাল, ভায়োলা ডেভিস, মেলিসা লিও, মারিয়া বেলো
IMDB: 8.1

" Every moment matters.."

“ভালো’র জন্য দোয়া করো, কিন্তু খারাপের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকো”; কেলার ডোভার কথাটা তার স্ত্রী গ্রেস ডোভারকে বলার সময় গলাটা একটু কেঁপে গিয়েছিলো কি? না মনে হয়। অথচ উচিৎ ছিলো কারন নিজের সাত বছরের মেয়ে এনা’র কিডন্যাপিং এর কথা বলছে সে। শুধু এনাই না; প্রতিবেশী বার্চ দম্পতীর মেয়ে জয়’ও নিখোজ। কে দায়ি এই কিডন্যাপিং এর জন্য? কেন’ই বা করেছে? দেখুন “প্রিজনারস্‌” মুভিটি। মূলত এই কিডন্যাপিং নিয়েই কাহিনী। IMDB তে 8.1, রটেন টমাটোতে ৮১% ফ্রেশারস্‌ রেটিং, সাথে ৮৮% অডিয়েন্স রেটিং... হলিউডে ঝড় তুলেছে কানাডিয়ান পরিচালক ডেনিশ ভিলেনিয়ুভ এর “প্রিজনারস্‌” মুভি। এই মুভিকে অলরেডি বলা হচ্ছে দশকের সেরা ক্রাইম থ্রিলার। হিউ জ্যাকম্যান, জেক ইলেনহ্যাল, ভায়োলা ডেভিস, মেলিসা লিও অভিনিত মুভিটি ক্রিটিকদের উচ্ছসিত প্রশাংসা পেয়েছে। মজার বিষয় হলো ডেনিশ ভিলেনিয়ুভ এর এটি প্রথম হলিউডের মুভি। এর আগে তার ফ্রেঞ্চ মুভি “ইন্সেন্ডাইস” বক্স অফিস বাজিমাত করেছিলো।

“প্রিজনারস আপনাকে ভুতের মত তাড়া করবে এবং আপনার সাথে আঠার মত লেগে থাকবে; এটা বছরের সেরা মুভিগুলোর একটা”; স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা এইভাবেই ব্যাখ্যা করেছে মুভিটিকে। কিডন্যাপিং নিয়ে কাহিনী সেটা আগেই বলেছি, আর কিচ্ছু বলব না তাইলে সম্পূর্ণ টুইস্ট’ই নষ্ট হয়ে যাবে। তবে এটা বলতে পারি এমন মুভি না দেখলে কিছুটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে আপনার ছায়াছবির জগৎ। একদম স্লো পেসড্‌ মুভি; কিন্তু তাই বলে ভেবে বসবেন না বোরিং। থ্রিল কাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কি কি তা হারে হারে বুঝিয়ে দেবে এই মুভি। এক মুহূর্ত আগেও আপনি বলতে পারবেন না পরে কি হবে। নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি রাত দুই’টার দিকে শুধু প্রিন্ট চেক করার জন্য মুভিটা চালু করেছিলাম। এরপর যতদুর মনে পরে পরবর্তি আড়াই ঘন্টা নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। এমন একটা মুভি যে শেষ না হলেই বোধহয় ভালো হত। কোথাও কোনো অসঙ্গতি নাই, প্রতিটি ক্যারেক্টার মিশে গিয়েছে মুভিতে। হিউ জ্যাকম্যান তার ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয় করে ফেলেছেন এই মুভিতে বলেই মনে করেন অনেকে। ডিটেকটিভ লোকি চরিত্রে জেক ইলেনহ্যালও ছিলেন অসাধারন। এ্যারন গুজিকোস্কি স্ক্রিপ রাইটার হিসেবে অস্কার পেয়ে গেলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। শ্বাসরুদ্ধকর এই ড্রামার প্রতিটি চরিত্রায়ন’ই অসাধারন। পরিচালক শেষ অবধি ধরে রেখেছেন টানটান উত্তেজনা। কোথাও কোনো তারাহুরা নাই, একেবারে ঠান্ডা মাথায় এগিয়েছে কাহিনী; তবে শরীরের প্রতিটি স্নায়ুকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। প্রয়োজনের খাতিরে কিছুটা ভায়োলেন্স আনতেই হয়েছে, তাই বলে রক্ত হীম করা নয়। ধাঁধা আর রহস্যে ঘেরা মুভিতে মাঝেই মাঝেই নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাবেন; ভাববেন একটা হবে আরেকটা। অনেক ভালো থ্রিলার’ই বাজে সমাপ্তির জন্য নষ্ট হয়ে যায়। এটা আপনি মনে রাখবেন কারন মুভির শেষটাও অসাধারন। অস্কার পাবে কি না এটা বলা দুষ্কর তবে বেশ কিছু ক্যাটাগরিতে নমিনেশান পাবার কথা “প্রিজনারস্‌” এর। যাই হোক, এত কথা না শুনে দেখে ফেলুল একটা পার্ফেক্ট ক্রাইম থ্রিলার। ঘুরে আসুন পেন্সিল্ভেনিয়া থেকে।